October 22, 2024, 3:34 am

বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীতে নানা সংকটে ব্যহত হচ্ছে উৎপাদন!

বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীতে নানা সংকটে ব্যহত হচ্ছে উৎপাদন!

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বিসমিল্লাহ পলিমার ও প্যাকেজিং মিলসের পলি তৈরি মেশিনটি চালু হওয়ার পর এটি উত্তপ্ত হয়ে উৎপাদন শুরু করতে সবমিলিয়ে চারঘন্টা সময় লাগে। হঠাৎ বিদুৎ চলে যাওয়ার কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি নতুন করে শুরু করতে হয়। এতে ব্যহত হচ্ছে উৎপাদন। ক্ষুদে উদ্যোক্তা ও বিসমিল্লাহ পলিমার এর পরিচালক নাজমুন নাহার রিনা জানালেন, প্রতিমাসে সাড়ে তিনলক্ষ টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেও পর্যাপ্ত সেবা বঞ্চিত আমরা। এজন্য বিসিকের নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা খুবই জরুরী। সাবস্টেশন নয়, পূর্ণাঙ্গ একটি বিদ্যুৎ স্টেশন বিসিকে প্রয়োজন দাবী করে রিনা বলেন, এখানে ছোটবড় ৭৫টি প্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার নারীপুরুষ কাজ করছে। বখাটেদের উৎপাত লেগেই আছে। তাই এখানে একটি পুলিশ ফাড়ি, একটি চিকিৎসাকেন্দ্র এবং ফায়ার সার্ভিসের শাখা থাকা খুবই জরুরী বলে জানান রিনা। তার সাথে সহমত পোষণ করেন বরিশাল বিসিকের ক্ষুদ্র শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জেআইবি ফুড প্রোডাক্টসের পরিচালক ইব্রাহিম খান। তিনি বলেন, একেতো আমাদের বিসিকের যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম আজো খুলনা নির্ভর হয়ে আছে। তারউপর বিসিক শিল্প এলাকার জন্য এজটি নিজস্ব বিদ্যুৎ স্টেশন দেয়ার কথা কিন্তু একটি সাবস্টেশন করে সেখান থেকে আবার বাহিরেও সংযোগ দেয়া হচ্ছে। ফলে বিসিক শিল্প এলাকার চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। এছাড়াও অগ্নি দুর্ঘটনা ও বখাটেদের উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য একটি হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসের শাখা ও পুলিশ ফাঁড়ি খুবই জরুরী প্রয়োজন বলে জানান বরিশাল বিসিকের ক্ষুদে উদ্যোক্তাদের অনেকেই। বরিশালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এর নির্ধারিত এলাকায় ইতিমধ্যেই বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরি জুতো, পোশাক, শিশু খেলনা, হস্তশিল্প, ফুডস, প্যাকেজিং ইত্যাদি বাজারজাত করে সুনাম অর্জন করেছে। এদের কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বলেও দাবী উদ্যোক্তাদের। যতদূর জানা যায়, বরিশালে বিসিক শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। প্রায় ১৩১ একর জমির ওই শিল্পনগরে ঐ সময়ে প্লটের সংখ্যা ছিলো ৪৪৬টি। এরমধ্যে ৩৭৮টি প্লট বরাদ্দ দিতে পেরেছিলো বিসিক প্রশাসন। বরাদ্দ করা প্লটে শিল্প ইউনিট সংখ্যা ছিলো ১৭৩টি যার মধ্যে ৭২টি উৎপাদনে ছিলো। পরবর্তীতে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে ২৩০ একর জমিতে দেশের সবচেয়ে বড় বিসিক শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা দীর্ঘদিন আটকে ছিলো বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক জটিলতায়। বর্তমানে সিটি বান্ধব মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের পর এ সংকট কেটেছে বলে জানান উদ্যোক্তারা। বরিশাল- ৫ আসনের সংসদ সদস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমও এখন বিসিক শিল্প এলাকা নিয়ে আন্তরিক বলে দাবী তাদের। এখানে এখন ছোট-বড় ১৩৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান কাজ করছে এবং ৭৫টি উৎপাদনশীল বলে জানান মালিক সমিতির নেতারা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ নিচু জমি ভরাট ইত্যাদি অব্যবস্থাপনায়। নতুন মেয়র দায়িত্ব নিয়েই ট্রেড লাইসেন্স জনিত সমস্যার সমাধান করে দেয়ায় ক্ষুদে উদ্যোক্তাদের চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। তবে একইসাথে জ্বালানি সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ভোলা থেকে পাইপলাইনে গ্যাস পেলে পণ্যের উৎপাদনে দ্বিগুণ খরচ কমে যাবে বলে দাবী তাদের। সরেজমিনে ৪ ফেব্রুয়ারী রবিবার বরিশাল সিটি করপোরেশন আওতাধীন কাউনিয়া এলাকার উত্তরপ্রান্তের বিসিক শিল্পনগরীতে প্রবেশমাত্রই চোখে পড়ে ট্রাক বোঝাই ময়লা আবর্জনা মাখা পলিথিন ঢুকছে একটি প্রতিষ্ঠানে। পিছু নিয়ে এগুলো কি ও কেন এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিস্মিত হতে হয়। বরিশাল বিসিকের একটি প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ পলিমার ময়লা আবর্জনা মাখা ফেলে দেয়া পলিথিন রিসাইকেলিং এর মাধ্যমে মনোপলি তৈরি করছে যা বাড়ি নির্মাণে ও ক্ষেত খামারে ব্যবহার করা যায়। তার এখানে প্রায় ৬০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী কাজ করছে। রয়েছে প্রতিবন্ধী ও সামাজিকভাবে অবহেলিত নারীরাও। প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজকেও পাওয়া গেল এখানে। তিনি জানালেন, এই প্রতিষ্ঠানে সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রের ছয়জন মেয়ে কাজ করছে। মাঝে মধ্যে এসে তিনি ওদের অবস্থা তদারকি করেন। বিসমিল্লাহ পলিমার থেকে একটু সামনেই জেআইবি ফুড প্রোডাক্টসের সাইনবোর্ড। আর একটু পশ্চিমে এগুতেই চোখে পড়ে ফরচুন গ্রুপের কারাখানা ও শ্রমিকদের কোলাহল। পুকুরের ওপারে আছে বেঙ্গল গ্রুপ। বরিশালে যে রপ্তানিমুখী ও আন্তর্জাতিক মানের শিল্প কারখানা চালানো যায়, তার প্রমাণ বহন করছে এই ফরচুন সুজ। ২০১২ সালে বরিশালের বিসিক শিল্পনগরে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এতে তৈরি জুতা রপ্তানি হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ফরচুন সুজের কারখানা ঘুরে এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কারখানার কাঁচামাল সবই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। আবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই জুতা ইউরোপে যায়। তাঁরা মূলত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্পোর্টসওয়্যার তৈরি করেন। ফরচুনের কর্মকর্তারা বলেন, পায়রা বন্দর চালু হলে তাঁদের কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিতে সময় কম লাগবে। ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করে জেআইবি ফুড প্রোডাক্টস ইতিমধ্যেই সারাদেশে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বাজারজাত করে সুনাম অর্জন করেছে। রংপুর, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জসহ ঢাকার বাজারে জেআইবি ফুডস এর খাদ্য পণ্যের ব্যাপক চাহিদা বলে জানান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইব্রাহিম খান। তিনি জানান, বরিশাল বিসিকে বর্তমানে ৭৫টি প্রতিষ্ঠান চলমান আছে। বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিশ দেয়া হয়েছে বলে জানালেন মালিক সমিতির এই নেতা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বরিশাল জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বড় ও মাঝারি শিল্প আছে ১৫টি। ক্ষুদ্র শিল্প আছে ১ হাজার ৯৫৫টি। কুটির শিল্প আছে ৯ হাজার ৭১৯টি। বরিশাল বিসিক শিল্প এলাকার প্রকল্প পরিচালক জালিস মাহমুদ জানান, বিসিকের উন্নয়নের জন্য ২০১৮ সালে ৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। ঐ টাকার বেশিরভাগ কাজই সম্পন্ন হয়েছে। চারপাশে দেয়াল ও নিচু জমি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধু ড্রেন ও কালভার্টের কাজ বাকী রয়েছে। এই কাজ শেষ হলে এখানে কমপক্ষে ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে জানান তিনি। এদিকে বরিশালের উন্নয়ন নিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, শিল্পের দিক দিয়ে বরিশাল অন্য বিভাগগুলোর চেয়ে পিছিয়ে। বরিশালে গ্যাস নেই। বিদ্যুতের ঘাটতিও প্রবল। উদ্যোক্তা, সস্তা শ্রম ও জমি থাকার পরও এই জেলায় শিল্পের বিনিয়োগ হয়নি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত কবি ও ছড়াকার তপংকর চক্রবর্তী বলেন, বরিশাল বিভাগে শিল্প গড়ার দিকে সরকারও কখনো নজর দেয়নি। যদি দিতেন তাহলে এতোদিনে এ শহরে গ্যাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত হতো। দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) হয়েছে। নতুন করে অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে, কিন্তু বরিশালে কিছুই হচ্ছে না। এমনকি বরিশালে যে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগর আছে, সেটিও অবহেলিত। যদিও বর্তমান সরকার ও বরিশালের প্রশাসন সম্প্রতি এদিকে মনোযোগ দিয়েছেন, তারা বিসিককে শক্তিশালী করতে সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন যৌথ উদ্যোগও শুরু করেছে শুনেছি। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিশ্চিত না হলে তারা কতটা কি করতে পারবেন তা প্রশ্ন বিদ্ধ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারিতে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগে ৪৫ হাজার ৭৩৫টি উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক ইউনিট আছে, যা সিলেট ছাড়া বাকি বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে সিলেট বিভাগে গ্যাস থাকায় সেখানে অনেক বড় বড় শিল্প হয়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। বরিশালেও সে সুযোগ পর্যাপ্ত রয়েছে, তবে গ্যাস এখানে খুবই জরুরী। বরিশালের সুশীল সমাজ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃবৃন্দ মনে করেন, পায়রা বন্দর চালু হলে ভবিষ্যতে দক্ষিণাঞ্চলে যত অর্থনৈতিক কর্মকা- হবে, তার কেন্দ্রবিন্দু হবে বরিশাল। এ জন্য গ্যাসের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে তারা বলেন, বরিশালে ১০০ জনের বেশি ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন। এখানে গ্যাস এলে তারাই তখন বরিশালে বিনিয়োগ করবেন। এতে করে রাজধানী কেন্দ্রিক চাপও অনেক কমে যাবে। বরিশাল বিসিক শিল্পনগরী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনেক প্লট এখনো খালি পড়ে আছে। অনেকগুলোতে পুরোনো শিল্পকারখানা বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ ও উদ্যোক্তাদের দাবীর কথা শুনে বরিশালের জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বিসিকের সম্ভাবনা তুলে ধরে বলেন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের কাজ প্রায় শেষ। দেশের সবচেয়ে বড় বিসিক শিল্পনগরী এলাকা এখন এই বরিশাল বিসিক। এটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শক্তিশালী করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বরিশাল জেলা প্রশাসন। তিনি বলেন, বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতিমধ্যেই নোটিশ দেয়া হয়েছে। তাদের অনুমোদন বাতিল করে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হবে। আগামীতে বরিশাল হবে একটি বাণিজ্যিক নগরী। তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিজ জেলায়, নিজ বিভাগে আরো বেশি বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © All rights reserved © 2024 DailyBiplobiBangladesh.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com